নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: বর্তমান পরিস্থিতি, আইন …
- Home
- -
- Submissions
- -
- Naripokkho
- -
- নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: বর্তমান পরিস্থিতি, আইন …
নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: বর্তমান পরিস্থিতি, আইন ও করণীয় বিষয়ক মতবিনিময় সভার প্রতিবেদন
তারিখ: ১৪ ভাদ্র ১৪২৩/ ২৯ আগষ্ট ২০১৬
স্থান: সম্মেলন কক্ষ, জেলা জজ আদালত, জামালপুর
আর্থিক সহায়তায় : মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
আয়োজনে : নারীপক্ষ ও তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থা, জামালপুর
নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম এবং জনগণের অংশগ্রহণ জোরদারকরণ প্রকল্পের আওতায় ১৪ভাদ্র ১৪২৩/২৯ আগষ্ট ২০১৬ সম্মেলন কক্ষ, জেলা জজ আদালত, জামালপুরে “নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: বর্তমান পরিস্থিতি, আইনও করণীয় বিষয়ক” মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব শামিমা খান নিবার্হী পরিচালক,তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থা, জমালাপুর । প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জনাব মো: সায়েদুর রহমান খান, বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ, জমালপুর। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জনাব বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, সমন্বয়কারী (অধিকার), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, জনাব মো: মজিবুর রহমান, বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট, জনাব জাহানার বেগম, বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, জনাব মো: আলমগীর, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর আর্থিক সহায়তায় তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থা, জামালপুর এবং নারীপক্ষ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
সভার উদ্দেশ্য :
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ সম্পর্কে সংশ্ল্টি পক্ষকে অবহিত করা এবং পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী যাতে এই আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা ও ন্যায় বিচার পায় সেই করণীয় চিহ্নিত করা।
অংশগ্রহণকারী :
সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জনাব, মো: সায়েদুর রহমান খান, বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ, জামালপুর। সভায় সম্মনিত অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট,সহকারী জজ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, আইনজীবী, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, পুলিশ, এনজিও প্রতিনিধি এবং সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, সমন্বয়কারী (অধিকার), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, রওশন আরা, প্রকল্প পরিচালক, নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম এবং জনগণের অংশগ্রহণ জোরদারকরণ প্রকল্প, শামীমা খান, নির্বাহী পরিচালক,তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থা, জামালপুর সভায় অংশগ্রহণ করেন ।
উন্মুক্ত আলোচনা : উন্মুক্ত আলোচনায় সঞ্চালকের ভ’মিকা পালন করেন রওশন আারা, প্রকল্প পরিচালক, নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম এবং জনগণের অংশগ্রহণ জোরদারকরণ প্রকল্প। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীদের মতামত নি¤œরুপÑ
জাহাঙ্গীর সেলিম, সাংবাদিক : পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের উপর তারা আইনটি সম্পর্কে ভালো ভাবে জানে না এবং এই আইনের প্রচার নাই। তাই মিডিয়া ক্যাম্পেইন, জনপ্রতিনিধিদের সচেতন করতে হবে, আইনের প্রচার করতে হবে।
শামীম আরা, এ্যাডভোকেট : এই আইনের প্রচারনার দরকার, গাইড লাইন তৈরী করে ওরিয়েন্টশন দরকার, ৩/৫ সদস্য বিশিষ্ট সেল তৈরী করা যারা আপোষ মিমাংসা করতে পারবে, সেল্টার হোম দরকার কারণ বেশীর ভাগ নারীর যাওয়ার কোন জায়গা থাকেনা, মহিলা বিষয়ক অফিসের লোকবল বৃদ্ধি করা।
লায়লা নাজনীন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, মেলান্দহ : ২০১০ সালে এই আইনটি প্রনয়ন হয়েছে কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। তবে আমরা উঠান বৈঠক, ভিজিডি বিতরণের সময় এই আইন সম্পর্কে আলোচনা করি।
লুৎফর রহমান কবির, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মমর্তা জামালপুর : পারিবারিক সমস্যা নিয়ে যারা আমাদের কাছে আসে তাদের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার পরামর্শ প্রদান করি। সহিংসতার শিকার নারীরা আদালতে যেতে রাজী হয় না। আমাদের বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হয়। এই আইন বাস্তবায়ন করতে হলে লোকবল বাড়ানো বা একাজ করার জন্য পৃথক লোক থাকা দরকার ।
চীফ জডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর কথার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, সহিংসতার শিকার নারী রাজি না হওয়ায় আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে পারি না।
মাসুদ রানা, প্রতিনিধি, স্বাবলম্বী : এই আইন সম্পর্কে সচেতন করার জন্য জনপ্রতিনিধি ও এনজিও প্রতিনিধিদের ওরিয়েন্টেশন করানো দরকার
শফিক, ব্র্যাক : জামালপুরে তাদের ১১টি আইনগত ক্লিনিক আছে। নির্যাতনের শিকার নারী আসলে আমরা অভিযোগ গ্রহণ করি এবং নোটিশ করে যোগাযোগ করি এবং সমস্যার সমাধান করে থাকি। সহিংসতার শিকার নারী নারী –শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে মামলা করে কিন্তু এই আইনে যেতে রাজী হয় না।
রাসেল, তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থা : আমরা সমস্যা শুনে সমাধান করে থাকি। এই আইনের আওতায় সালিশের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি চালূু করলে মামলার জট কমবে, হয়রনীর শিকারও কম হবে।
আশরাফুল, সাব-ইন্সপেক্টর, সদর থানা : পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কেউ থানায় আসলে আমরা দুইপক্ষকে নিয়ে সমাধান করি। তবে যারা মামলা করতেই চাই তখন করি।
নয়ন, সাব-ইন্সপেক্টর, সদর থানা : বেশীর ভাগ মামলা আসে যৌতুকের এবং সেগুলো বেশীর ভাগই মিথ্যা। এই জন্য পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কেউ থানায় আসলে দুইপক্ষকে নিয়ে সমাধান করার জন্য আমাদের কাছে নির্দেশনা আসছে এবং আমরা তা করি।
শফিকুল ইসলাম, আইনজীবী: জামালপুরে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা ) আইন ২০১০ এই আইনটি তেমন প্রচলিত না। বেশীর ভাগ মামলা যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারা এবং নারী শিশু আইনের ১১(গ) ধারায় হয় । বেশীর ভাগ মামলা গ্রাম থেকে আসে । তারা এসে জানতে চায় কোন আইনে কি শাস্তি আছে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা ) আইনে তেমন শাস্তি না থাকায় তারা এই আইনে মামলা করতে আগ্রহী হয় না। গ্রামের লোকজন যেহেতু চেয়ারম্যান মেম্বারদের কথা শোনে এবং তারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও করে থাকে কাজেই এই আইনের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে চেয়ারম্যান মেম্বারদের সচেতন করতে হবে।
নিষ্কৃতি হাগিদক, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট: এই আইনের কিছু অসংগতি রয়েছে। যেমন- যে সব সন্তান বৃদ্ধ বাবা/ মাকে নির্যাতন করে সেই বিষয়টি অন্তভর্’ক্ত করা হয়নি। আইনে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ও পুলিশকে প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তবে সমস্যা আপোষ করার বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট ধারণা নাই।হেফাজতের বিষয়ে সুনিদির্ষ্ট তেমন বিধি নাই। বিধিমালাতে যে প্রেসক্রাইব ফরমেটের কথা বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তা অনুসরণ করছে কিনা, কি ভাবে নিষ্পত্তি করছে এবং যে গুলোর নিষ্পত্তি করতে পারে না সেগুলো আদালতে প্রেরণ করবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নাই। তবে আইনজীবীদের কাছে যারা আসে তাদের আন্তরিক ভাবে বুঝালে হয়তো কেউ কেউ এই আইনে মামলা করবে।
গোলাম রসুল, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট: পারিবারিক সহিংসতা প্রচুর হয় তবে পারিবারিক বন্ধন টিকিযে রাখার জন্য এই আইনে মামলা করতে চায না। তৃনমূল পর্যায়ে এই আইন নিয়ে আলোচনা দরকার।
ফাতেমা ইমরোজ ক্ষণিকা যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ : অসহায় ব্যক্তিরা আইন সম্পর্কে জানে না। প্রয়োগকারী সংস্থাকে এই আইনের সুযোগ সম্ভাবনাগুলো বুঝাতে হবে। বিচারকদের সুযোগ কম তাই পুলিশ, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই সুবিধা দিতে পারে।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, কর্মসূচি সমন্বয়কারী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন : তিনি বলেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। যখন এই অধিকারের ক্ষেত্রে অসমতা, বৈষম্য দেখি তখন সেগুলো নিয়েআমরা কাজ করি, এ্যাডবোকেসী করি। আমরা পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, শ্রম আইন, তথ্য অধিকার আইন নিয়েকাজ করি। সরকার, মানবাধিকার কমিশন এর সাথে কাজ কাজ করি, গবেষণা করি। ল্যান্ড মার্ক জাজমেন্ট বইগুলো কর্মএলাকার আদালতে প্রদান করা হয়েছে।
তিনি পূর্বের বক্তাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলেন, এই আইনে নারীকে আদালতে যাওয়ার কথা বলা হয়নি। প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বৃদ্ধ বাবা/মা –র বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন এই আইনে কেবল নারীর জন্য বলা হয়েছে। সহিংসতার শিকার নারী এই আইনে মামলা করথে আগ্রহী না কারণ তারা সচেতন না। তারা সচেতন হলে মারখেতো না।তিনি বলেন, শাস্তিই অপরাধীকে বদলে দিতে পারে না। এই আইনে সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করা। মহিলা বিষয়ক, পুলিশ এবং সেবা প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় খুব জরুরী।
মজিবুর রহমান, সিজিএম : উচ্চ পর্যায়ে না হয়ে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সচেতন করতে হবে
মো: সায়েদুর রহমান, জেলা জজ : তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নাই। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনটি অনেক ভালো এবং কিছু ভালো ব্যবস্থাও আছে যেমন সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে। এই আইনের প্রচার না থাকায় জনগণ যেমন এই আইনের সুবিধা সম্পর্কে জানে না অপরদিকে আইনজীবীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী আসলে সুরক্ষার জন্য কোন পদক্ষেপ নেন না। এই আইনের সঠিক প্রয়োগে হলে সংসার টিকে থাকবে, সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। তাই সেবা প্রদানকারী সংস্থা, প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সং¤িøষ্ট সকলকে আন্তরিক হতে হবে।
সুপারিশ/ পরামর্শ:
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য সেবা প্রদানকারী সংস্থা, প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সং¤িøষ্ট সকলের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। সেই সাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই আইনটি সুয়োগ সম্ভাবনা গুলো প্রচার করলে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। পরিবারের মধ্যে নিরাপদে বসবাস করে নারী যেন তার নায্য বিচার পায় সেই জন্যই এই আইন। কাজেই পারিবারিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না বরং পারিবারি বন্ধন অটুট রাখার জন্যই এই আইনটির প্রচার এবং বাস্তবায়নে আমাদের সকলকে আন্তরিক, দায়িত্বশীল এবং এগিয়ে আসতে হবে।
প্রস্তুতকারী:
সাবিনা ইয়াসমিন
প্রোগ্রাম অফিসার